সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ :
সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের তত্ত্ব সমকালীন চিন্তা-চেতনা ও চাহিদার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিকাশ ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি বড় ঘটনা। এই ঘটনার পিছনে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। দেশের ভিতরে ও বাইরে পুঁজিবাদের প্রসারকে বৈধতাযুক্ত করার উদ্দেশ্যে অস্টিন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের উপর জোর দেন।
অস্টিনের সংজ্ঞা: সার্বভৌমিকতা সম্বন্ধে অস্টিনের সংজ্ঞা হল: ‘যদি কোন নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষ অন্য কোন ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করে এবং কোন বিশেষ সমাজের অধিকাংশের স্বভাবগত আনুগত্য লাভ করে থাকে, তাহলে সে সমাজে উক্ত নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ হল সার্বভৌম এবং উক্ত কর্তৃপক্ষসহ সমাজটি হল একটি রাজনীতিক এবং স্বাধীন সমাজ’ (‘If a determinate human superior, not in a habit of obedience to a like superior, receives habitual obedience from the bulk of a given society that determinate superior is sovereign in that Society and the Society ( including the superior) is a Society Political and independent.”)।
বৈশিষ্ট্য: অস্টিনের সার্বভৌমিকতার ধারণা সম্পূর্ণ আইনগত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন আইনবিদ। তাঁর মতে, ‘সার্বভৌমের নির্দেশই হল আইন’ (“Law is the command of the Sovereign.”)। আইনের পেছনে রয়েছে সার্বভৌমের শাস্তিদানের ক্ষমতা। তাঁর মতানুসারে নৈতিক সূত্র বা প্রথার সঙ্গে আইনের কোন সম্পর্ক নেই। অস্টিন প্রচলিত প্রথা বা নীতিগত ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে আইনকে ব্যাখ্যা করেননি। তাঁর মতানুসারে আইন হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বর্তনের আজ্ঞা।
অস্টিন-প্রদত্ত সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়: (১) অস্টিনের মতে, সার্বভৌম শক্তি বলতে একটি নির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষকে বোঝায়। এ ‘জনমত’ বা ‘সাধারণের ইচ্ছা’ (General Will) প্রভৃতি কোন অস্পষ্ট বা নৈর্ব্যক্তিক কর্তৃপক্ষকে বোঝায় না। এ সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। (২) সার্বভৌম ক্ষমতা হল চরম, অবাধ ও অসীম। এ অপর কোন শক্তির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে না। (৩) সার্বভৌমের আদেশই হল আইন। এর নির্দেশ অমান্য করার অর্থ আইন অমান্য করা। আইন অমান্য করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। (৪) জনগণের স্বভাবগত আনুগত্যই সার্বভৌমিকতার ভিত্তি। (৫) সার্বভৌম ক্ষমতা হল সকল অধিকারের উৎস। এর বিরুদ্ধে কোন আইনগত অধিকার থাকতে পারে না। (৬) সার্বভৌম শক্তি অবিভাজ্য। (৭) রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে সার্বভৌমিকতা সমানভাবে সকলের উপর প্রযুক্ত হয়। (৮) সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব বর্তমান থাকে কেবলমাত্র রাজনীতিক ও স্বাধীন সমাজে।
ল্যাস্কির মত: অস্টিনের সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব পর্যালোচনা প্রসঙ্গে ল্যাস্কি বলেছেন: (ক) অস্টিনের মতানুসারে রাষ্ট্র হল আইনানুসারে সংগঠিত একটি সংস্থা (legal order)। এখানে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব (state power) হল যাবতীয় ক্ষমতার উৎস। (খ) এই ক্ষমতা অসীম ও অনিয়ন্ত্রিত। (গ) এই শক্তির আদেশই হল আইন। আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে।
সমালোচনা (Criticism): সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকগণের মধ্যে হেনরী মেইন, সিজউইক, ক্লার্ক, ল্যাস্কি, ম্যাকাইভার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য।
(১) রাজনীতিক সার্বভৌমিকতাকে উপেক্ষা আইনগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্টিন সার্বভৌম শক্তির চরম, অবাধ ও অসীম ক্ষমতার কথা বলেছেন। কিন্তু রাজনীতিক সার্বভৌমিকতা বা গণসার্বভৌমিকতার ধারণা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক সার্বভৌমিকতা বা জনমতই হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মূল চালিকা শক্তি। কারণ গণতন্ত্র বলতে জনমতের অনুগামী শাসনকেই বোঝায়। সুতরাং সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের ধারণা গণতন্ত্রসম্মত নয়। গিলক্রিস্টের মতানুসারে আইনসঙ্গত সার্বভৌমিকতার পিছনে রাষ্ট্রের যে সমষ্টিগত প্রভাব বর্তমান সেগুলির ঐক্যবদ্ধ রূপই হল রাজনীতিক সার্বভৌমিকতা। বস্তুত জনমত গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রভাব ও নির্বাচকমণ্ডলীকে একত্রে রাজনীতিক সার্বভৌম বলা হয়ে থাকে। এই রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার কাছে আইনসঙ্গত সার্বভৌমিকতাকে নতি স্বীকার করতে হয়। অস্টিনের মতানুসারে ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রানীসহ পার্লামেন্ট হল সার্বভৌম। কিন্তু এই সার্বভৌম ব্রিটিশ পার্লামেন্টও জনমতকে উপেক্ষা করে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইনগত অবাধ ক্ষমতার ভিত্তিতে পার্লামেন্ট এমন আইন প্রণয়ন করতে পারে যে সকল কৃষ্ণকেশী বা কৃষ্ণনয়না শিশুকন্যাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু এ ধরনের কোন আইন বলবৎ হতে পারে না। ব্যাপক গণবিক্ষোভের অপ্রতিহত জোয়ারে এই আইন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। অর্থাৎ আইনগত সার্বভৌমের ক্ষমতা রাজনীতিক সার্বভৌমের দ্বারা সীমাবদ্ধ। অস্টিন এই রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন।
(২) অপ্রতিহত ক্ষমতার ধারণা ঠিক নয়: অস্টিন আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলেছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা চূড়ান্ত, অবাধ ও অসীম। এই ক্ষমতা অন্য কোন শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। কিন্তু বাস্তবে আজ পর্যন্ত কোন সার্বভৌম সম্পূর্ণ অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়নি। অবাধ ও অসীম সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ কোথাও প্রবল প্রতিরোধকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, কোথাও কোন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ অবাধ ও অসীম ক্ষমতা কার্যকর করতে সক্ষম হয়নি। এই কারণে অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত হল যে, সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ কৃত্রিম এবং অবাস্তবতা দোষে দুষ্ট। ডাইসির মতে যে-কোন সার্বভৌমের প্রকৃত ক্ষমতা বাহির ও অন্তর দু’দিক থেকেই সীমাবদ্ধ।
(৩) আইন সম্পর্কিত ধারণা ভ্রান্ত: অস্টিনের মতে সার্বভৌমের নির্দেশই হল আইন। কিন্তু ঐতিহাসিক সম্প্রদায়ভুক্ত হেনরী মেইন প্রমুখ লেখকগণের মতে প্রত্যেক দেশেই দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বহু প্রথা, রীতিনীতি, লোকাচার প্রভৃতি থাকে। এগুলি সার্বভৌমের নির্দেশ নয়। তবুও এগুলি আইনের মত কার্যকরী হয়। প্রবল পরাক্রান্ত নৃপতিও এ সকল প্রথাগত আইনকে উপেক্ষা করতে পারেন না। দৃষ্টান্ত হিসাবে পঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংহের কথা বলা যায়। বলা হয় যে, তাঁর মত পরাক্রান্ত রাজাও প্রথাগত বিধানগুলিকে অনুমোদন করেছেন। এক্ষেত্রে অস্টিনের বক্তব্য হল যে, সার্বভৌমের অনুমোদনই হল তাঁর নির্দেশ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ প্রথাগুলিকে অনুমোদন করা ছাড়া সার্বভৌমের আর কোন উপায় থাকে না। সুতরাং আইনের বিশ্লেষাত্মক ধারণার সমালোচনার উত্তরে অস্টিন যা বলেছেন তা অভ্রান্ত নয়। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে আইন হল সামাজিক প্রয়োজনের ফল। দ্যুগুই (Duguit) বলেছেন: “Laws are merely the expression of social necessary.” মেইন (Henry Maine) -এর মতে, “Law is the result of a varying, progressive, slow and lengthy formation by society, rather than of the arbitrary will of a law-giver.”
(৪) আইনমাত্রেই নির্দেশমূলক নয়: অস্টিন-প্রদত্ত আইনের সংজ্ঞা থেকে আইনের প্রকৃতি সম্বন্ধে যে ধারণা জন্মায় তাও সর্বাংশে সত্য নয়। সকল আইনই সার্বভৌম শক্তির নির্দেশ বা আজ্ঞা নয়। বহু ‘অনুমতি জ্ঞাপনসূচক’ আইনও প্রচলিত থাকে। বস্তুত ল্যাস্কি অস্টিনের আইন সম্পর্কিত ধারণাকে মেনে নেননি। আইনকে অস্টিন সার্বভৌমের আদেশ হিসাবে অভিহিত করেছেন। ল্যাস্কি আইনের এই তত্ত্বকে স্বীকার করেননি। সমালোচনা করতে গিয়ে A Grammar of Politics গ্রন্থে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন : “To think…of law as simply a command is, even for the jurist, to strain definition to the verge of decency.”
(৫) পীড়নমূলক শক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ: অস্টিন পীড়নমূলক শক্তির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি নিয়ম-শৃঙ্খলার পূর্বে শক্তিকে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে শক্তি প্রয়োগ বা শাস্তির লোকে আইন করে ল। বস্তুত এ কথা ঠিক নয়। নানা কারণে লোক আইন মানতে অভ্যস্ত বলেই আইন কার্যকরী হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনীতিক কারণে মানুষ অভ্যাসবশে আইন মান্য করে চলে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকের মতানুসারে রাষ্ট্রপূর্ব অবস্থাতেও সমাজে কতকগুলি সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুশাসন প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণ বর্তমান ছিল। লর্ড ব্রাইস আইন মান্য করার কারণ হিসাবে নির্লিপ্ততা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, শাস্তির ভয় ও যৌক্তিকতার উপলব্ধির কথা বলেছেন। লীকক (Leacock) তাঁর Elements of Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, অস্টিনের এই মতবাদ সমাজ ও সরকারের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও সাধু দিকগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মতবাদটি মূলতঃ বিমূর্ত কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে। তার ফলে মতবাদটি বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্করহিত হয়ে পড়েছে।
(৬) সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য: অস্টিনের একত্ববাদে একটি নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষকে সার্বভৌম বলা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারেই হল সার্বভৌম। কিন্তু আমরা জানি সার্বভৌমিকতা বাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরকারের নয়।
(৭) সংকীর্ণ: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের তত্ত্ব সংকীর্ণ এবং একদেশদর্শিতা দোষে দুষ্ট। কারণ অস্টিন কেবল আইনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন।
(৮) যুক্তরাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের অবস্থান নির্ধারণ অসম্ভব: আবার নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বতন মানবীয় কর্তৃপক্ষকে যদি সার্বভৌম বলতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের অবস্থান নির্ণয় অসম্ভব। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এ হেন কোন মানবীয় কর্তৃপক্ষের সন্ধান পাওয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন সরকার বা সরকারের কোন অংশ সার্বভৌম নয়। তাই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে অস্টিনের ব্যাখ্যা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। ল্যাস্কির মতানুসারে যুক্তরাষ্ট্রে সার্বভৌমিকতার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা অসম্ভব। হেনরী মেইন-এর অভিমত অনুসারে সব সময় নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের মধ্যে সার্বভৌমিকতার অবস্থান নির্দেশ করা সম্ভব নয়। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ মেনে নিলে দেশের নির্বাচকমণ্ডলীকেও সার্বভৌম বলা যায় না। কারণ নির্বাচকমণ্ডলী বলতে কোন নির্দিষ্ট সংস্থাকে বোঝায় না।
(৯) বহুত্ববাদীদের সমালোচনা: সার্বভৌমিকতা প্রসঙ্গে অস্টিনের একত্ববাদী ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ। তাঁদের মতে, সমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় সংস্থা, শ্রমিক সংঘ প্রভৃতি বহু জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান আছে। ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের ক্ষেত্রে এগুলির অবদানও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সার্বভৌমিকতার উপর রাষ্ট্রের মত এদের দাবিও উপেক্ষা করা উচিত নয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “These associations are in their sphere, not less sovereign than the state itself.” তাঁর মতানুসারে মানুষের আনুগত্য বহুমুখী। তাই রাষ্ট্র এককভাবে কখনই চরম সার্বভৌমিকতা দাবি করতে পারে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক, রাজনীতিক, ধর্মীয় সংগঠনগুলিও স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম। রাষ্ট্র হল, এই সমস্ত সংগঠনগুলির মতই একটি সংগঠন। দ্যুগুই, ক্র্যাবে, গিয়ার্কে, বার্কার প্রমুখ বহুত্ববাদীরা অস্টিনের এই একত্ববাদী তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এঁদের মতানুসারে রাষ্ট্র এককভাবে সার্বভৌমিকতার অধিকারী হতে পারে না। রাষ্ট্র অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রে সার্বভৌমিকতা ভোগ করবে।
(১০) আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সমালোচনা: অস্টিনের সার্বভৌমিকতা সংক্রান্ত তত্ত্ব আন্তর্জাতিকতাবাদিগণের দ্বারাও সমালোচিত হয়েছে। তাঁদের মতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রই চরম ও সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। ল্যাস্কি বলেছেন: “Externally surely, the concept of an absolute and independent Sovereign State… is incompatible with interests of humanity.” তিনি আরও বলেছেন: “The nation of an independent sovereign state on the international side, is fatal to the well-being of humanity.” রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার অবসান ব্যতিরেকে যুক্তিসঙ্গত জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি ও বিশ্বজনমতের চাপকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কোন রাষ্ট্রেরই নেই। আবার বিংশ শতাব্দীর সভ্যযুগে বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি স্বৈরী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার দ্বারা সীমাবদ্ধ। বর্তমানে প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইন মান্য করতে হয়। তাই কোন রাষ্ট্রই এককভাবে চরম বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার অধিকারী হতে পারে না। আন্তর্জাতিক স্তরে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্বীকার করা হয়, তা হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। এই কারণে মানবজাতির সুস্থ অস্তিত্বের স্বার্থে সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদকে মেনে নেওয়া যায় না। এখন পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় আতঙ্কিত রাষ্ট্রসমূহ সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সদস্য গ্রহণ করেছে। এর অর্থ হল সদস্য রাষ্ট্রগুলি জাতিপুঞ্জের সনদের বিধিনিষেধ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়েছে।
(১১) অগণতান্ত্রিক: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত অস্টিনের মতবাদ গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী। এই মতবাদ অনুসারে আইনগত সার্বভৌম চরম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। এই সার্বভৌমের ইচ্ছাপ্রসূত পীড়নমূলক আইন গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জনগণের সার্বভৌমিকতার ধারণার উপর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। অস্টিনের মতবাদে একে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই মতবাদ জনগণের ইচ্ছা, অধিকার বা স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্করহিত।
(১২) প্রতিক্রিয়াশীল: মার্কসীয় চেতনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অস্টিনের এই একত্ববাদী তত্ত্ব প্রতিক্রিয়াশীল। মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত কোন শ্রেণী-সরকারের হাতে এই ধরনের সার্বভৌম ক্ষমতা নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। ধন-বৈষম্যমূলক বা শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এই ধরনের সার্বভৌম কর্তৃত্ব সংখ্যালঘু বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থে এবং সংখ্যাগুরু বিত্তহীনদের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হয়।
মূল্যায়ন (Evaluation): অস্টিনের সার্বভৌমিকতা সংক্রান্ত একত্ববাদের বহু বিরূপ সমালোচনা বর্তমান। এতদ্সত্ত্বেও মতবাদটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বহু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে অস্টিনের সমালোচকগণ একত্ববাদের সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারেননি। সিজউইক, ল্যাস্কি প্রমুখ সমালোচক মন্তব্য করেছিলেন যে অস্টিন সার্বভৌমিকতা ও পীড়নমূলক শক্তিকে অভিন্ন মনে করেছেন। কিন্তু কোকার বলেন, অস্টিনের তত্ত্বে এরূপ অভিন্নতার কথা কোথাও বলা হয়নি। অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুরূপ মত পোষণ করেন। ফ্রান্সিস গ্রাহাম উইলসন্-এর মতানুসারে, অস্টিন এমন মূর্খ ছিলেন না যে, তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অর্থে সরকারের স্বেচ্ছাচারের ক্ষমতাকে বুঝিয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে অস্টিন তাঁর সংজ্ঞায় সার্বভৌম