হরপ্পা জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন কী ছিল | What were the religious beliefs and practices of the Harappan people?

হরপ্পা জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন

হরপ্পা সভ্যতা, যা সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত, প্রায় ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অবস্থিত ছিল এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে। হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনগুলি মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সিল, মূর্তি, এবং নগর পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায়। এই সভ্যতার ধর্মীয় জীবন পরবর্তী সময়ের হিন্দু ধর্মের কিছু মৌলিক উপাদানের প্রাথমিক চিহ্ন বহন করে, যদিও সরাসরি কোনো ধর্মগ্রন্থ বা লেখা পাওয়া যায়নি।

১. দেবতা ও মূর্তি:

হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দেবতা ও মূর্তির পুজা। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননে কিছু মূর্তি পাওয়া গেছে যা ধর্মীয় পূজা ও পূজার অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় মূর্তি হল “প্রাতিবিম্ব দেবী” বা “মাতৃ দেবী” মূর্তি, যা সাধারণত মাটির তৈরি এবং মহিলার উরু ও স্তন উঁচু অংশের সাথে প্রকাশিত। এই মূর্তি সম্ভবত প্রাচীন পণ্য উৎপাদন, উর্বরতা, এবং মাতৃ-ভিত্তিক দেবতাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হত।

২. পবিত্র স্থান ও মন্দির:

হরপ্পা নগরের নগর পরিকল্পনার মধ্যে পবিত্র স্থান বা সম্ভবত মন্দিরগুলির অস্তিত্বের কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিছু স্থানীয় জলাধার এবং বিহারীর মতো অবকাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় বা আচার-অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হত। যদিও কোনো বিশেষ মন্দিরের খোঁজ পাওয়া যায়নি, তথাপি এই স্থানগুলি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

৩. সিল ও প্রতীক:

হরপ্পা সভ্যতার সিলগুলিতে ধর্মীয় প্রতীক ও চিহ্নগুলি পাওয়া গেছে, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের ধারণা প্রকাশ করে। এই সিলগুলিতে সাধারণত দেবতার চিত্র, মূর্তি, এবং ধর্মীয় প্রতীক দেখা যায়। কিছু সিলের উপরে পাসপোর্ট বা সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলির পাশাপাশি পঞ্চভূত (পানি, মাটি, বায়ু, অগ্নি, এবং আকাশ) এর ধারণা প্রতিফলিত হয়।

৪. পূজা ও আচার-অনুষ্ঠান:

হরপ্পা সভ্যতার পূজা এবং আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। নগরের মধ্যে কিছু অঞ্চল সম্ভবত ধর্মীয় পূজা এবং আচার-অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে, নগরের জলাধারগুলি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা শুদ্ধতা ও পবিত্রতার জন্য ব্যবহৃত হত।

৫. পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস:

হরপ্পা সভ্যতার মানুষের পরিবেশগত বিশ্বাসও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদীর গুরুত্ব, বিশেষ করে সিন্ধু নদীর গুরুত্ব, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ ছিল। নদীর সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও পূজা-অর্চনার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংযুক্ত ছিল।

৬. মৃত ব্যক্তির জন্য আচার:

হরপ্পা সভ্যতার মৃত্যু ও সমাধি প্রথা ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ ছিল। কিছু স্থানীয় সমাধির খোঁজ পাওয়া গেছে যা মৃতদের সম্মানে নির্মিত ছিল। মৃতদের জন্য বিশেষ কিছু উপহার ও অস্ত্রের সাথে সমাধি করার প্রথা প্রমাণিত হয়েছে, যা জীবনের পরের পর্যায়ে বিশ্বাসের অংশ ছিল।

উপসংহার:

হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনগুলি ধর্মীয়, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। দেবতা ও মূর্তি, পবিত্র স্থান ও মন্দির, সিল ও প্রতীক, পূজা ও আচার-অনুষ্ঠান, পরিবেশগত বিশ্বাস, এবং মৃত ব্যক্তির জন্য আচার-অনুষ্ঠান প্রমাণ করে যে হরপ্পা জনগণের ধর্মীয় জীবন ছিল একটি সমৃদ্ধ ও জটিল ব্যবস্থা। এই প্রমাণগুলি ধর্মীয় জীবন, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, এবং সামাজিক কাঠামোর একটি সমন্বিত চিত্র প্রদান করে। যদিও সরাসরি ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায়নি, তথাপি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি তুলে ধরে।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading