সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর | Discuss the Monistic Theory of Sovereignty.

Table of Contents

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব

ভূমিকা

সার্বভৌমিকতা (Sovereignty) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা, যা রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতা বোঝায়। এটি এমন একটি ধারণা যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব (Monistic Theory of Sovereignty) এই ধারণাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার একক উৎসকে কেন্দ্র করে। এই তত্ত্বটি ১৯শ শতাব্দীর রাজনীতিবিদ এবং দার্শনিক জন বডিন (Jean Bodin) এবং পরবর্তীতে থমাস হোবস (Thomas Hobbes) এর দ্বারা উন্নত করা হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য, উপাদান, এবং এর সমালোচনা বিশ্লেষণ করব।

সার্বভৌমিকতার ধারণা

সার্বভৌমিকতা শব্দটি ল্যাটিন শব্দ “সুপ্রেমাস” থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “সর্বোচ্চ”। এটি একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানকে বোঝায় যা কোনো বাহ্যিক কর্তৃত্বের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। সার্বভৌমিকতা দুটি দিক নিয়ে গঠিত:

  1. অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা: এটি রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন বোঝায়। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকে।
  2. বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা: এটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিষয়ক স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমিক রাষ্ট্রের সমতা বোঝায়। বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা মানে রাষ্ট্রের স্বাধীনভাবে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং পরিচালনা করার ক্ষমতা।

একত্ববাদী তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব বলে যে সার্বভৌমিকতা একটি অবিভাজ্য এবং একক সত্তা, যা রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতার উত্স। এই তত্ত্বের প্রধান পয়েন্টগুলি হলো:

  1. ক্ষমতার একক উৎস: একত্ববাদী তত্ত্বের মূল ধারণা হলো ক্ষমতার একক উৎস। এটি মানে যে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি কেন্দ্র বা ব্যক্তি থেকে উত্পন্ন হয়। এই কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং সমস্ত নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানকে মানতে বাধ্য।
  2. অবিভাজ্যতা: একত্ববাদী তত্ত্বের মতে, সার্বভৌমিকতা অবিভাজ্য। এটি অর্থনৈতিক, সামরিক, বিচারিক, বা আইন প্রণয়ন ক্ষমতায় কোনো বিভাজন বা বিকেন্দ্রীকরণ সহ্য করে না।
  3. সর্বময় ক্ষমতা: সার্বভৌমিক ক্ষমতা সর্বোচ্চ এবং অপরিবর্তনীয়। কোনো বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ শক্তি এই ক্ষমতা সীমিত করতে পারে না।
  4. লিগ্যালিটি: একত্ববাদী তত্ত্বের অধীনে, সার্বভৌমিক রাষ্ট্রের আইন সর্বোচ্চ এবং সর্বত্র প্রযোজ্য। কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি আইনের উপরে নয়।

প্রধান চিন্তাবিদ এবং তত্ত্বের উন্নয়ন

জন বডিন (Jean Bodin) জন বডিন ছিলেন ১৬শ শতাব্দীর একজন ফরাসি দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ, যিনি সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা। তার মতে, সার্বভৌমিকতা হলো একক এবং অবিভাজ্য ক্ষমতা যা আইন প্রণয়ন এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। বডিনের মতে, সার্বভৌমিক ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, বরং অনির্দিষ্টভাবে বিদ্যমান থাকে।

থমাস হোবস (Thomas Hobbes) থমাস হোবস, একজন ইংরেজ দার্শনিক, তার “লেভিয়াথান” (Leviathan) বইতে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের একটি শক্তিশালী ব্যাখ্যা দেন। হোবসের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন “নির্দয়, নিষ্ঠুর, এবং সংক্ষিপ্ত” ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি শক্তিশালী সার্বভৌমিক কর্তৃপক্ষ বা “লেভিয়াথান” অপরিহার্য যাতে সমাজে শৃঙ্খলা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। হোবসের মতে, এই সার্বভৌমিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা অবিভাজ্য এবং চূড়ান্ত হওয়া উচিত, এবং এর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত নয়।

সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতা

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের অনেক সমালোচনা হয়েছে, যা তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতার সাথে এর অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরেছে:

  1. ক্ষমতার বিভাজন: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, ক্ষমতার বিভাজন একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। আইন প্রণয়ন, প্রশাসন, এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। একত্ববাদী তত্ত্ব এই ক্ষমতার বিভাজনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে, যা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
  2. বিকেন্দ্রীকরণ এবং ফেডারালিজম: বিকেন্দ্রীকরণ এবং ফেডারেলিজম ধারণাগুলি একত্ববাদী তত্ত্বের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই তত্ত্বটি সমস্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে, যেখানে ফেডারেলিজম কেন্দ্র এবং রাজ্য বা প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি করে।
  3. মানবাধিকার এবং আইনের শাসন: একত্ববাদী তত্ত্বের অধীনে, সার্বভৌমিক ক্ষমতা চূড়ান্ত এবং সর্বত্র প্রযোজ্য, যা ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতাকে হ্রাস করতে পারে। মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের সুরক্ষার জন্য ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং বিবিধ ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।
  4. আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃতি: বর্তমান বিশ্বে, আন্তর্জাতিক আইন এবং প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। একত্ববাদী তত্ত্ব সার্বভৌমিক রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করে না, যা আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

উপসংহার

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। জন বডিন এবং থমাস হোবসের মতো চিন্তাবিদরা এই তত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে আধুনিক বিশ্বে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনা রয়েছে, যা ক্ষমতার বিভাজন, মানবাধিকার, এবং আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে। তত্ত্বটি এখনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল ধারণাগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়, যা রাজনীতির ভিত্তি বোঝাতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন-

আদর্শ স্থাপনকারী দৃষ্টিভঙ্গী | Normative Approach

রাষ্ট্রের প্রকৃতির নিরিখে মার্ক্সীয় তত্ত্বটির মূল্যায়ন কর।

সমাজতত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি

বিতরণকারী ন্যায়ের তত্ত্বটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর

রাষ্ট্রের উদ্ভবে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি সংক্ষেপে আলোচনা কর

রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়নে আচরণবাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দাও। জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা কর

স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি আলোচনা কর। স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর |

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা কর |

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা কর |

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading