রুশোর মতে নারীশিক্ষার উপর একটি টীকা লেখো।

রুশোর মতে নারীশিক্ষার উপর একটি টীকা

মার্ক্স-পূর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো, যাঁর রচনা অন্তত একটি বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলো। সাম্যবাদী মার্ক্সের রচনায় যেমন শ্রেণীসংগ্রাম, রোম্যানটিক রুশোর রচনায় তেমনি প্রকৃতি; এবং প্রকৃতি নামক মিথ্যার শেকলে রুশো বন্দী করেছেন নারীকে।

রুশো বিভিন্ন রচনায় বিচার করেছেন নারীর প্রকৃতি বা স্বভাব, শিক্ষা, ও সামাজিক-রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারীর স্থান। নারী সম্পর্কে তাঁর আবেগতাড়িত মত পশ্চিমকে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো, পশ্চিমের দেশেদেশে তাঁর মতকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো উগ্রভাবে, কেননা পশ্চিম রুশোর মধ্যে পেয়েছিলো এক নতুন বিধানকর্তাকে। রুশো, ফরাশি বিপ্লবের দার্শনিক, বিরোধী ছিলেন সমস্ত শৃঙ্খলের, ভাঙতে চেয়েছিলেন সমস্ত শেকল ও মূর্তি; কিন্তু নারীর জন্যে তিনি তৈরি করেছিলেন অনেকগুলো শক্ত শেকল, এবং অবিনশ্বর করে রাখতে চেয়েছিলেন পিতৃতন্ত্রেব তৈরি নারীমূর্তিটি। তাঁর বিখ্যাততম উক্তি : ‘মানুষ জন্মে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’–সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য শুধু পুরুষ-মানুষের ক্ষেত্রে।

‘মানুষ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘পুরুষ’, নারী রুশোর কাছে মানুষ ছিলো না। নারী পরাধীনভাবে জন্ম নিলেও তাঁর কোনো আপত্তি থাকতো না, খুবই সুখী বোধ করতেন। তিনি, কেননা তাহলে নারীকে সুচারুরূপে পুরুষাধীন করার জন্যে এতোগুলো বই তাকে লিখতে হতো না। নারী সম্পর্কে রুশোর দর্শনের সম্পূর্ণটাই ভ্ৰান্ত, যার সারকথা হচ্ছে: ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, এবং তাকে চিরকাল পুরুষাধীন রাখতে হবে’ বা ‘নারী জন্মে পুরুষাধীন, তবে কোনো নারী যদি স্বাধীনভাবে জন্ম নেয়, তবে পুরুষের কাজ হচ্ছে তাকে পুরুষাধীন করা।

’ মানুষ ও রুশোর জন্যে বিশেষ মর্মান্তিক যে সাম্যমুক্তির এ-দার্শনিক রচনা করেছিলেন নারীকে বন্দী করার দর্শন, যা বাতিল ক’রে দেয় তাঁর মূল দার্শনিক প্রতিপাদ্যকে। রুশো ছিলেন পিতৃতন্ত্রের এক বড়ো পুরোহিত। পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নারীপুরুষের যে-বিভেদ ও চালিয়েছে যে-পীড়ন, রুশো তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের জন্যে তিনি নির্দেশ করেন। সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ও বিপরীত স্থান ও ভূমিকা। তবে তিনি নারীপুরুষের ভিন্ন স্থান ও ভূমিকাকে দাবি করেছেন ধ্রুব সত্যরূপে; তাঁর মতে, নারীপুরুষের প্রথাগত স্থান ও ভূমিকা কোনো প্রথা বা সামাজিক ব্যাপার নয়, তা প্রাকৃতিক। তবে তাঁর কাছে পুরুষের জন্যে যা প্রাকৃতিক নারীর জন্যে তা প্রাকৃতিক নয়, নারীপুরুষ রুশোর দর্শনে দুই প্রকৃতির অন্তর্গত।

তাই প্রকৃতির এ-দার্শনিক সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন কী প্রাকৃতিক নারীর জন্যে, আর কী প্রাকৃতিক পুরুষের জন্যে। নারীর প্রকৃতি রুশো নির্দেশ করেন নারীর ভূমিকা বা উপযোগিতা অনুসারে, অর্থাৎ নারীর যৌন ও সন্তান জন্ম দানের উদ্দেশ্য দিয়ে; আর পুরুষের প্রকৃতি নির্দেশ করেন পুরুষের চিন্তাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতার অশেষ সম্ভাবনা দিয়ে। রুশোর নারী জৈবিক, পুরুষ অজৈবিক; নারী মাংস, পুরুষ দেবদূত। রুশোর নারী শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গত; আর পুরুষ সৃষ্টিশীল ও মননশীল। এসব ধারণা রুশো পেয়েছেন প্রথা থেকে; এবং প্রথা থেকে পেয়েছেন নারী সম্পর্কে আরো অনেক অশীল ধারণা। পশ্চিমের পিতৃতন্ত্র যেমন নারীকে মনে করে সমস্ত অশুভর উৎস, রুশোর চোখেও নারী পৃথিবীর সমস্ত অশুভর প্রধান উৎস। নারী সম্পর্কে রুশোর সমগ্র দর্শনই ভ্ৰান্ত; তিনি তার চারপাশে যা দেখেছেন, তাকেই ধ্রুবসত্য ব’লে গণ্য করে চর্চা করেছেন দর্শনের।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading