ভারতের উপমহাদেশে নিওলিথিক সংস্কৃতি:
নিওলিথিক যুগ, বা নবপাথরযুগ, মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় যা প্যালিওলিথিক (প্রাচীন পাথরযুগ) থেকে ব্রোঞ্জ যুগের (তাম্রযুগ) মধ্যে একটি সংযোগকারী স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রায় ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল এই যুগের অন্তর্ভুক্ত, এবং এটি ভারতীয় উপমহাদেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সময়কাল। নিওলিথিক সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল স্থায়ী বসতি স্থাপন, কৃষির উন্নতি, এবং উন্নত প্রযুক্তি।
১. প্রযুক্তিগত পরিবর্তন:
ক. কৃষির প্রবর্তন:
নিওলিথিক যুগে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল কৃষির প্রবর্তন। মানুষেরা শিকার ও সংগ্রহের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে কৃষিকাজ শুরু করে। তারা বিভিন্ন ফসল যেমন গম, ধান, মশুর, ও পাথরের সাহায্যে চাষ করতে শিখে। এই পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের সংখ্যা বাড়ে, যা বসতিস্থাপন ও সমাজের জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
খ. পাথরের সরঞ্জাম:
নিওলিথিক যুগে পাথরের সরঞ্জামগুলির উন্নতি ঘটে। আগের তুলনায় এই সময়ের পাথরের সরঞ্জামগুলি বেশি প্রাথমিক, চূড়ান্ত, এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়। পাথরের ছুরি, খুঁটি, পালিশ করা মৃৎশিল্প, এবং অন্যান্য সরঞ্জামগুলি কৃষি, নির্মাণ, এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হত।
গ. মৃৎশিল্প :
মৃৎশিল্প ও ক陶器 (পটারি) নিওলিথিক যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উন্নতি। বিভিন্ন ধরনের পাত্র, থালা, ও অন্যান্য মৃৎশিল্পের উপকরণ তৈরি করা হয় যা খাদ্য সংরক্ষণ, রান্না, ও আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত। পটারি তৈরির প্রযুক্তি উন্নতির ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ে এবং সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে।
ঘ. স্থাপত্য ও বসতি:
নিওলিথিক যুগের মানুষেরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন ধরনের বাড়ি ও মাটির নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করে। বাড়িগুলি সাধারণত মাটির তৈরি এবং কিছু ক্ষেত্রে ইট বা পাথরের ব্যবহার ছিল। স্থাপত্যের এই উন্নতি স্থায়ী বসতি, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা উন্মোচন করে।
২. অর্থনৈতিক পরিবর্তন:
ক. কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন:
নিওলিথিক যুগে কৃষি একটি প্রধান অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হয়ে ওঠে। স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থার ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটায়। খাদ্য উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট জমির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রবর্তিত হয়।
খ. বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক:
নিওলিথিক যুগে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন হয় এবং নতুন ধরনের পণ্য ও প্রযুক্তি একে অপরের সাথে বিনিময় করা হয়। মৃৎশিল্পের তৈরি পণ্য, ক陶器, ও কৃষি পণ্যগুলি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অংশ হয়ে ওঠে।
গ. সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি:
এই যুগে অর্থনৈতিক কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। কৃষি ও পণ্য উৎপাদনের বৃদ্ধির ফলে সম্পদ বিতরণ ও সামাজিক শ্রেণীবিভাগের প্রমাণ পাওয়া যায়। নতুন ধরনের শিল্প, পণ্য উৎপাদন, এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক উন্নতির একটি স্পষ্ট চিহ্ন।
৩. ভারতের উপমহাদেশের নিওলিথিক সংস্কৃতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান:
ক. মেহরগড় (Mehrgarh):
মেহরগড়, যা বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত, নিওলিথিক যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে প্রথম কৃষি, মৃৎশিল্প, ও স্থায়ী বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেহরগড়ের নিওলিথিক বসতির বৈশিষ্ট্যগুলি কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র প্রদান করে।
খ. মত্তুরা (Mattur):
মত্তুরা, কर्नাটকের একটি স্থান, নিওলিথিক যুগের পটারি ও মৃৎশিল্পের জন্য পরিচিত। এখানে প্রাপ্ত নিওলিথিক পটারি ও সরঞ্জামগুলি কৃষি ও শিল্পের উন্নতির প্রমাণ।
গ. হাজী গোলা (Haji Ghol):
হাজী গোলা, যা বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত, নিওলিথিক যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে নিওলিথিক ক陶器 ও কৃষির প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি চিত্র প্রদান করে।
ঘ. বালাথল (Balathal):
বালাথল, রাজস্থানের একটি স্থান, নিওলিথিক যুগের মৃৎশিল্প, কৃষি, ও স্থায়ী বসতির জন্য পরিচিত। এখানে খননের সময় প্রাপ্ত মৃৎশিল্প ও কৃষির নিদর্শনগুলি প্রাচীন মানুষের জীবনযাত্রার একটি প্রমাণ।
ঙ. চান্দেল (Chandela):
চান্দেল, মধ্যপ্রদেশের একটি স্থান, নিওলিথিক যুগের মৃৎশিল্প ও স্থাপত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রাপ্ত মৃৎশিল্প ও স্থাপত্য নিদর্শনগুলি এই যুগের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক উন্নতির প্রমাণ।
উপসংহার:
নিওলিথিক যুগ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল ছিল। কৃষির উন্নতি, পাথরের সরঞ্জাম, মৃৎশিল্প, স্থাপত্য, এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের পরিবর্তনগুলি এই যুগের বৈশিষ্ট্য এবং অবদান প্রকাশ করে। এই যুগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি প্রমাণ করে যে নিওলিথিক সংস্কৃতি মানুষের জীবনযাত্রার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং ভবিষ্যতের সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নিওলিথিক যুগের প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলি আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।