বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

“বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন”- রবীন্দ্রনাথ

 পুণ্যশ্লোক মহাপুরুষর বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিরাট বিস্ময়রূপে প্রতিভাত  হয়েছেন। সহজ সাবলীল ও গতিশীল বাংলা গদ্য ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর পূর্বে রামমোহন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকগণ বাংলা গদ্য রচনা করলেও তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা সাধু গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম:  

বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারক, তাই নির্মল সাহিত্য প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তিনি সমাজ ও মানুষের প্রয়োজনেই লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর সমগ্র রচনাকর্মকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- শিশুপাঠ্যগ্রন্থ, অনুবাদ ও মৌলিক কথামালা প্রধান।  তাঁর শিশুপাঠ্য গ্রন্থ গুলির মধ্যে “বর্ণপরিচয়”, “বোধোদয়”, “কথামালা” প্রধান। বিভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদ গ্রন্থ গুলি হল “বেতাল পঞ্চবিংশতি”, “শকুন্তলা”, “সীতার বনবাস”, “ভ্রান্তিবিলাস” প্রভৃতি। তাঁর মৌলিক গ্রন্থগুলি হল “বিদ্যাসাগর চরিত”, “প্রভাবতী সম্ভাষণ”, “অতি অল্প হইল”, “আবার অতি অল্প হইল”, “ব্রজবিলাস”, “সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব”, “বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব”, “বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার” প্রভৃতি।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান:

• বাংলা গদ্য রচনায় বিদ্যাসাগর পূর্বসূরী রামমোহন কে অনুসরণ করলেও তিনিই প্রথম বাংলা গদ্য রীতিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে নিজের স্বকীয়তা বা মৌলিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

•বাংলা গদ্যের জড়তা ও দুর্বোধ্যতা দূর করে সাহিত্য সৃষ্টির উপযোগী সুললিত গদ্যরীতির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন – যা সাহিত্য ও সংসারের সর্বপ্রকার প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয়েছিল।

• শুধু সুললিত কোমলতা নয় তাঁর সমাজ সংস্কারকমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধের ভাষা অভ্রান্ত যুক্তি তর্ক, তথ্যের সমারোহ ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের বাহন হয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন ও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে।

• উপযুক্ত স্থানে তৎসম শব্দ, তদ্ভব ক্রিয়াপদ ও ইডিয়াম ব্যবহার করে বাংলা গদ্যে তিনি বিশেষ শব্দোচ্ছলতার পরিচয় দিয়েছেন।

• বাংলা গদ্যে যতি সন্নিবেশ করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দবিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেছেন। বাংলা গদ্যে এমন ধ্বনি ঝংকার ও সুরবিন্যাসের স্রষ্টা তিনিই।

• বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা গদ্য পেয়েছে প্রাণ। হয়ে উঠেছে সাবলীল, প্রাঞ্জল ও প্রসাদগুণ সমন্বিত। সার্থক বাংলা গদ্যের প্রতিষ্ঠা তাঁর হাতেই। তাই তিনি বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক।

সমালোচনা: বিদ্যাসাগরের গদ্যে সংস্কৃত শব্দের আধিক্য থাকাটা বিস্ময়কর নয়, কারণ সাধু ভাষায় ব্যবহৃত অধিকাংশ শব্দই তৎসম। ভাষা পরিবর্তনের সাথে সাথে বিদ্যাসাগরের ভাষা আজ আমাদের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য বা কঠিন বলে মনে হলেও সেখানে এই ভাষা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং তাঁর পরিকল্পিত সাধু গদ্যই প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির লেখনীর মুখে ভাষা যুগিয়েছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য স্মরণযোগ্য- “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষায় উচ্ছৃঙ্খল

জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যাস্ত,সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কর্মকুশলতা দান করিয়াছেন- তখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতিই ভাব প্রকাশের কঠিন বাধাসকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র অধিকার করিয়া লইতে পারেন- কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশভাগ সর্বপ্রথম তাঁহাকে দিতে হয়”।

নিদর্শন: “একে কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাত্রি, সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃতা, তাহাতে আবার ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল, আর ভূত প্রেতগণ চতুর্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এরূপ সংকটে কাহার হৃদয়ে না ভয় সঞ্চার হয়”। (বেতাল পঞ্চবিংশতি)

উপসংহার: বিদ্যাসাগর যেন গ্রহান্তরের কক্ষপথ থেকে ছিটকে এসে পড়েছিলেন উনিশ শতকের বাংলা দেশে। তাঁর জ্যোতির্ময় অগ্নিবলয়ের দিকে আমরা চেয়ে থাকতে পারিনি। তিনি হতভাগ্য বাঙালি জাতির চরিত্রে প্রেম ও পৌরুষ জাগাতে চেয়েছিলেন। সকল প্রলোভন ত্যাগ করে নিজের সাহিত্য চেষ্টাকে সমাজের কল্যাণের অভিমুখে চালিত করেছিলেন। বাঙালিকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন আদর্শ গদ্যভাষা। তিনি সমগ্র জাতীর চিরনমস্য।

Share

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading