অথবা, রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ পাঠ বিশ্বাসের রাজনীতি বনাম বিশ্বাসের আধ্যাত্মিক নীতি
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ নাটকে বরাবর এই দুটি ভাবের বিরোধ বেধেছে- প্রেম আর প্রতাপ। রঘুপতির প্রভুত্বের ইচ্ছার সঙ্গে গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের শক্তির দ্বন্দ্ব বেধেছিল। রাজা প্রেমকে জয়যুক্ত করতে চান, রাজপুরোহিত নিজের প্রভুত্বকে। নাটকের শেষে রঘুপতিকে হার মানতে হয়েছিল। তাঁর চৈতন্য হল, বোঝবার বাধা দূর হল, প্রেম হল জয়যুক্ত।”- বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ এইভাবেই ‘বিসর্জন’ নাটকের পরিচয় তুলে ধরেছে।
কিন্তু নাটকটির নিবিড় পাঠে আমরা দেখতে পাব গোবিন্দমাণিক্যের প্রেম এবং রঘুপতির প্রতাপের দ্বন্দ্বের নাটক এ নয়। এর মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। এ দ্বন্দ্ব প্রেম এবং প্রতাপের নয়, রাজার প্রতাপের সাথে রাজপুরোহিতের প্রতাপের দ্বন্দ্ব। তবে প্রতাপের সাথে প্রতাপের দ্বন্দ্ব-বিরোধ খোঁজার মাধ্যমে ‘বিসর্জন’ নাটকের প্লট হাতড়ানোই কেবল হবে। নাটকের অন্তে জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জনের ভেতর দিয়ে জীবিতদের মনে যে অসামান্য জীবনবোধনের আবিষ্কারপর্ব আসে তাকে নিতান্তই উপেক্ষা করা হবে। বরং এভাবে বিসর্জনে’র পরিচয় তুলে ধরার মধ্যে নাটককে কেবল মানবদ্বন্দ্বের প্রতিরূপায়ণ বলেই স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু এর ফলে (বিসর্জন) নাটক যে অবশেষে কবিতাও তাই অস্বীকার করা হয়।
বিসর্জনে’র অন্তরালবর্তী কবিত্বের আবহ খুঁজে পাওয়ার শর্তে এই লেখার শুরুতেই আমরা অনুমানরূপে প্রস্তাব করব এ আসলে মৃত্যুর নাটক। জয়সিংহের প্রাণ বিসর্জন অর্থাৎ তার স্বেচ্ছা-মৃত্যু-বরণ এর ভেতরের নাটক ঘনিয়ে তুলেছে। তাই এই লেখায় গোবিন্দমাণিক্যের প্রেম এবং রঘুপতির প্রতাপের দ্বন্দ্বের রেখায় ‘বিসর্জন’ পাঠ থেকে সরে গিয়ে বরং আমরা জয়সিংহের চরিত্র নির্মাণ, এই চরিত্রায়নের ধারণাগত কাঠামো ও পরিণতি নির্ধারণের কৌশলগত এবং ভাবগত প্রেক্ষিতগুলোর উন্মোচনে মনোনিবেশ করবো।
মৃত্যুর মতো বেদনাময় সৌন্দর্য
আমরা দেখছি জয়সিংহ মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যু দিয়ে জীবিতের পক্ষে কী ফায়দা হাসিল করা সম্ভব? কিন্তু এই নাটকে ‘মৃত্যু একটা উপলক্ষ্য মাত্র’। এই উপলক্ষের প্রকৃত লক্ষ্য নির্ণয় করতে বিশ্বভারতীর গ্রন্থনবিভাগ নয়, কবি শঙ্খ ঘোষের দোহাই দিতে পারি আমরা-
“তর্কে অথবা তত্ত্বে যেন অনেকটা অস্ফূট হয়ে আসে আমাদের জীবন, সহজ সম্পর্কের মাঝখানে একটা বাধা তৈরি হয় যেন। তেমন-কোনো তর্কের মধ্য দিয়ে নয়, সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়ে জীবনকে পেতে চান একজন কবি, এ বিশ্বকে তিনি দেখতে চান তার সমগ্র স্বরূপে। এমন কবিস্বভাবের কয়েকটি মানুষকে প্রায়ই আমরা দেখতে পাব রবীন্দ্রনাথের নাটকে। কবি বলে তাদের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি অবশ্য, তাদের পরিচয় আছে কেবল তাদের বেদনার গাঢ়তায়, অনুভবের সত্যে
শঙ্খ ঘোষ “আমাদের প্রিয় তেমনি কয়েকটি মানুষ” হিসেবে বির্সজনে’র জয়সিংহের নাম নিয়েছেন। জয়সিংহের মৃত্যুকে তিনি “সহজ সরল জীবনের অনন্ত প্রসারিত পথ” কেন বলছেন? কারণ জয়সিংহ একদিকে ভালোবাসে রঘুপতিকে, ভালোবাসতে পারে না ভ্রাতৃহত্যার ষড়যন্ত্রকে, তবে মনের ভেতরে ভিখারিণী অপর্ণার শুনতে পাওয়া ডাককে ভাবে প্রেম, দেবীকেও সে ছাড়তে পারে না। এই সব ভালোবাসার ভেতরে থেকে থেকে তার একটা উত্তরণ ঘটে। সেই উত্তরণ অন্তরের, দিব্যচোখে ব্যক্তিগত সীমা পেরোনো সত্য অবলোকনের পর্বে পৌঁছার। জয়সিংহ তখন অবসানের আসন্নতা পূর্ণভাবে অনুভব করে এবং রক্তে রক্তে টের পেয়ে যায় যে, “দৈনন্দিনের একটা ক্লীব আবর্ত আছে, সে আমাদের জড়িয়ে ফেলতে চায় গ্লানির পাকে, এর থেকে দূরে দাঁড়াবার মতো একটা আসক্তিহীনতার খুব দরকার।”৩ সেই প্রয়োজনেই নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ জয়সিংহের মতন কবিচরিত্রগুলোকে সম্পর্কহীন করে রাখেন কিনা এই প্রশ্ন তুলে কবি শঙ্খ ঘোষ যে জবাব দেন তা হলো, “তখন তারা সংসার থেকে অল্প আলগা হয়ে দাঁড়াতে পারে হয়তো, জীবনের একটা দিক থাকে খোলা, আর সেই খোলা পথেই তারা সংসারকে দেখতে পায় তার সমগ্র স্বরূপে, তার বেদনাময় সৌন্দর্যে ।”৪ তাহলে ‘বিসর্জন’ হলো বেদনাময় সৌন্দর্যের নাটক। কারণ জয়সিংহ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছে “মৃত্যুর অর্থে নয়, সুন্দরের অর্থে”।৫
প্রতাপ (রাজদর্প) বনাম প্রতাপ (ঠাকুরের প্রভুত্ব)
অতএব, বিশ্বভারতীর গ্রন্থপরিচয়ে প্রচারিত প্রেম আর প্রতাপের বিরোধ নিয়ে গড়ে ওঠা ‘বিসর্জন’ নাটক আমরা সতর্কভাবে পাঠ করে দেখছি যে, প্রেম আর প্রতাপের বিরোধ নয়, বরং এক প্রকার প্রতাপের সাথে আরেক প্রকার প্রতাপের বিরোধ ঘটে বলেই অবশেষে এই বেদনাময় সৌন্দর্যের নাটকের মুখোমুখি হই আমরা।
তবে প্লটনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ পারংগম নন, এই বহুশ্রুত অভিযোগটিকে কমপক্ষে ‘বিসর্জন’ নাটকের ক্ষেত্রে সারবান নয় বলে, শঙ্খ ঘোষের সাথে যূথবদ্ধ হয়ে, এই লেখায় আমরা এও প্রস্তাব করতে পারি, জয়সিংহের বিসর্জনের উপরিভাগের নাট্যপ্রবাহ তৈরি হয়েছে গোবিন্দমাণিক্য আর রঘুপতির মধ্যকার ধর্মরক্ষা নিয়ে পারস্পরিক বিরোধের কারণে। নাটকের পরিশিষ্ট অংশে মুদ্রিত বিশ্বভারতীর ব্যাখ্যায় এই বিরোধ যথার্থভাবে চিহ্নিত হয়নি বলেই নাটকটির পাঠার্থ নিয়ে মরীচিকা উৎপন্ন হয়। এই নাটকের পরিশোধিত পাঠের প্রয়োজনে নাটকটি থেকেই নেয়া নিচে উদ্ধৃত সংলাপিকাগুলো পর্যালোচনা করতে পারি-
“রঘুপতি। রাজার ভাণ্ডারে এসেছি/বলির পশু সংগ্রহ করিতে।
গোবিন্দ। মন্দিরেতে জীববলি এ বৎসর হতে/হইল নিষেধ।
রঘুপতি। এ কি স্বপ্নে শুনি?
গোবিন্দ। স্বপ্ন নহে প্রভু! এতদিন স্বপ্নে ছিনু,/আজ জাগরণ। বালিকার মূর্তি ধ’রে/স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন,/জীবরক্ত সহে না তাঁহার। রঘুপতি। এতদিন/সহিল কী করে? সহস্র বৎসর ধ’রে/রক্ত করেছেন পান, আজি এ অরুচি! গোবিন্দ। করেন নি পান। মুখ ফিরাতেন দেবী/করিতে শোণিতপাত তোমরা যখন। রঘুপতি। মহারাজ, কী করিছ ভালো করে ভেবে/ দেখো। শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে। গোবিন্দ। সকল শাস্ত্রের বড়ো দেবীর আদেশ। রঘুপতি। একে ভ্রান্তি, তাহে অহংকার! অজ্ঞ নর,/তুমি শুধু শুনিয়াছ দেবীর আদেশ,?আমি শুনি নাই?
গোবিন্দ। দেবী-আজ্ঞা নিত্যকাল ধ্বনিছে জগতে।/ সেই তো বধিরতম যেজন সে বাণী/ শুনেও শুনে না।”
এই সংলাপিকাগুলো শুনে আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্রাহ্মণ রঘুপতি ও রাজা গোবিন্দমাণিক্যের পরস্পর নির্ভরশীল একটি সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক ব্রাহ্মণের দিক থেকে অর্থনৈতিক ও রাজার দিক থেকে সাংস্কৃতিক। ধর্মাচারের জন্য প্রথা অনুযায়ী ।