জ্ঞানের উত্স সম্পর্কিত ক্যান্টের সমালোচনা মূলক তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করুন। এটি একটি সন্তোষজনক তত্ত্ব?

জ্ঞানের উত্স সম্পর্কিত ক্যান্টের সমালোচনা মূলক তত্ত্ব

ইমানুয়েল কান্টকে সাধারণত আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে সর্বোত্তম বলে মনে করা হয়। যদিও তিনি সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লবের সময় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি পূর্ব প্রাশিয়ার কোনিসবার্গে দর্শন পড়ানো থেকে কখনও বিরত থাকেননি। তাঁর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান হল সবিচার দর্শনের আবিষ্কার। এটি একটি উপাত্ত যা মনে করে যে বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান আছে, যা খোঁজ নেয় কিভাবে এই জ্ঞান সম্ভব এবং এই খোঁজের উত্তরে জগতের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন অধিবিদ্যক ফলও নিঃসৃত হয়েছে। এই ফলগুলো সত্য কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু কান্ট নিঃসন্দেহে দুটি বিষয় সম্পর্কে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন? প্রথমত, এই বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য যে আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান থাকে যা সম্পূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক নয়, অর্থাৎ এটি এমন যার বিপরীতটি স্ববিরোধিতায় দুষ্ট; এবং দ্বিতীয়ত, জ্ঞানতত্ত্বের দার্শনিক গুরুত্বকে প্রকাশ করা।

কান্টের সময়ের পূর্বে, সাধারণত বলা হত যে কোন পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞান অবশ্যই বিশ্লেষণাত্মক। এই শব্দটি কি বোঝায় তা প্রকাশ করা যেতে পারে উদাহরণের সাহায্যে। যদি আমি বলি, একটি টাক-মাথা ব্যক্তি হয় একজন ব্যক্তি, একটি সাধারণ মূর্তি হয় একটি মূর্তি, একজন মন্দ কবি হয় কবি, তাহলে আমি বিশুদ্ধ বিশ্লেষণই উপস্থাপিত করছি। যে বিষয় সম্পর্কে বলা হচ্ছে তার অনন্ত দুটি গুণ রয়েছে, যার মধ্যে একটিকে আলাদা করে নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। উপরের এই বচনগুলো হল তুচ্ছ এবং এদেরকে বাস্তব জীবনে গ্রহণ করা যায় না কোন বক্তার কুতর্কের পথ প্রস্তুত করা ছাড়া। এই বচনগুলোকে বিশ্লেষণাত্মক বলা হয়, কেননা উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলেই এর বিধেয়কে পাওয়া যায়।

কান্টের পূর্ববর্তী হিউম (১৭১১-৭৬) জ্ঞানের পূর্বতসিদ্ধ সাধারণ মত গ্রহণ করে আবিষ্কার করেছিলেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেগুলোকে আগে বিশ্লেষণাত্মক বলে ধরা হয়েছিল, এবং বিশেষত কারণ ও কার্যের ক্ষেত্রে, সংযোগটি হল আসলে সংশ্লেষণাত্মক। হিউমের পূর্ববর্তী বুদ্ধিবাদীরা অন্তত মনে করেছিলেন যে কার্যটি যৌক্তিকভাবে কারণের থেকে নিঃসৃত করা যায়, যদি আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকে। হিউম যুক্তি দেখিয়েছিলেন এবং সঠিকভাবেই দেখিয়েছিলেন যা এখন স্বীকার করা হয় যে এটা করা সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি অনেক বেশি সন্দেহপূর্ণ বচন অনুমান করেছিলেন যে কারণ ও কার্যের সংযোগ সম্পর্কে কোন কিছুই পূর্বতসিদ্ধভাবে জানা সম্ভব নয়। কান্ট, যিনি বুদ্ধিবাদীদের ধারায় শিক্ষিত হয়েছিলেন, হিউমের এই সংশয়বাদের দ্বারা বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে শুধুমাত্র কারণ কার্যের সংযোগই নয়, বরং গণিত ও জ্যামিতির সমস্ত বচন হল সংশ্লেষণাত্মক অর্থাৎ বিশ্লেষণাত্মক নয়। এই সমস্ত বচনে, উদ্দেশ্যের কোন বিশ্লেষণ বিধেয়কে পরিস্ফুটিত করে না। তারা বাধা উদাহরণ হল ৭ + ৫ = ১২ এই বচনটি। তিনি যথার্থভাবে দেখিয়েছিলেন যে ১২ পেতে গেলে ৭ এবং ৫- কে একত্রিত করতে হবে। ১২-র ধারণা এদের মধ্যে নেই, এমনকি দুটি ধারণার একত্রীকরণের মধ্যেও নেই। এভাবে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে সব শুদ্ধ গণিত পূর্বতসিদ্ধ হলেও তা প্রকৃতপক্ষে সংশ্লেষণাত্মক এবং এই সিদ্ধান্ত একটি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল যার সমাধান খুঁজতে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন।

কান্ট তাঁর দর্শনের শুরুতে যে প্রশ্নটি রেখেছিলেন তা হল–কিভাবে শুধু গণিত সম্ভব? এটি একটি চিত্তাকর্ষক এবং দুরুহ প্রশ্ন যার উত্তর প্রত্যেক দর্শন (যা পুরোপুরি সংশয়াত্মক নয়) অবশ্যই খোঁজার চেষ্টা করে। আমরা আগেই দেখেছি যে শুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদীরা যে উত্তর দেয় অর্থাৎ আমাদের গণিতের জ্ঞান বিশেষ ক্ষেত্রের থেকে আরোহের মাধ্যমে প্রাপ্ত, তা দুটি কারণে অপ্রতুলঃ প্রথমত, আরোহের নীতির শুদ্ধতা আরোহের সাহায্যে প্রমাণিত করা সম্ভব নয়; দ্বিতীয়ত, গণিতের সামান্য বচনগুলো যেমন দুই আর দুই সবসময় চার, এটি নিশ্চয়তার সঙ্গে জানা যায় শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্র বিবেচনা করে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের গণনা করে কিছু জানা যায় না যেসব ক্ষেত্রে এদের সত্য বলে জানা গিয়েছে। এভাবে আমাদের গণিতের সামান্য বচনের জ্ঞানকে (এই একই বিষয় তর্কবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) অবশ্যই ব্যবহারিক সামান্যকরণের চেয়ে অন্যভাবে দেখাতে হবে, যেমন– সব মানুষ হয় মরণশীল।

সমস্যাটির উদ্ভব হয় এই বিষয়ের মধ্যে দিয়ে যে এই ধরনের জ্ঞান হল সামান্য, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতাই হচ্ছে বিশেষ। এটা অদ্ভুত যে আমরা বিশেষ বিষয় সম্পর্কে কিছু সত্যতা পূর্ব থেকে জানতে পারব যার সম্পর্কে এখনও আমাদের কোন অভিজ্ঞতা হয়নি, কিন্তু এটি এত সহজে সন্দেহ করা যায় না যে যুক্তি বিজ্ঞান ও পাটিগণিতে এই বিষয়টি প্রয়োগ করা যাবে। আমরা জানি না ১০০ বছর পরে কারা লন্ডনের বাসিন্দা হবে, কিন্তু আমরা জানি যে এদের মধ্যে যে-কোন দুজন এবং আরও দুজন মিলে চারজন হবে।

কান্ট মনে করেন আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দুই ধরনের বিষয় আছে যাদের মধ্যে পার্থক্য করা দরকার। একটি হল বিষয়ের জন্য (যাকে আমরা বাহ্যবস্তু বলি), আরেকটি আমাদের নিজেদের স্বভাবের জন্য। জড় এবং ইন্দ্রিয় উপাত্ত নিয়ে আলোচনার সময় আমরা দেখেছি যে বাহ্যবস্তু ইন্দ্রিয়-উপাত্তের থেকে আলাদা এবং ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল বাহ্যবস্তু ও আমাদের মধ্যে যোগাযোগের ফল। এই পর্যন্ত আমরা কান্টের সঙ্গে একমত।

বাহ্য বস্তু, যাকে তিনি বস্তু-স্বরূপ বলেন, তা তাঁর মতে অজ্ঞেয়। যা আমরা অভিজ্ঞতায় পাই তাই বিষয় হিসেবে জ্ঞাত হয় যাকে তিনি আভাস বলেন। আভাস, আমাদের এবং বস্তুস্বরূপের যুগ্ম ফল হিসাবে অবশ্যই সেই বিশেষত্ব থাকবে যা ব্যক্তির জন্য ঘটে।

আমাদের পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানকে নিশ্চিত করে। এভাবে এই জ্ঞান সব বাস্তব ও সম্ভাব্য অভিজ্ঞতায় সত্য হলেও তা অবশ্যই অভিজ্ঞতার বাইরে প্রয়োগ করা যাবে না। এভাবে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আমরা বস্তুস্বরূপ সম্পর্কে কিছু জানি না অথবা যা বাস্তব ও সম্ভাব্য অভিজ্ঞতার বিষয়ে পড়ে তা-ও জানি না। এভাবে তিনি বুদ্ধিবাদীদের মত এবং অভিজ্ঞতাবাদীদের যুক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

কান্টের দর্শনের ছোটখাটো সমালোচনা ছাড়া একটি প্রধান আপত্তি রয়েছে যা তার পদ্ধতি অনুসরণ করে পূর্বতসিদ্ধ জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে মারাত্মক। আমাদের বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হবার বিষয়টি অবশ্যই যুক্তিবিজ্ঞান ও পাটিগণিতের অনুমোদন সাপেক্ষ হতে হবে। যুক্তিবিজ্ঞান ও পাটিগণিত ব্যক্তিমনের দ্বারা সমৃদ্ধ, একথা দিয়ে এক ব্যাখ্যা করা যায় না। বাস্তব জগতের মতো আমাদের স্বভাবও হল একটি বিষয়, এবং এ বিষয়, নিশ্চয়তা দেয়া না যে এটি একই থাকবে। কান্টের বক্তব্য সঠিক হলে এটা ঘটা সম্ভব যে আগামীকাল আমাদের স্বভাব এতটাই বদলে যাবে যে দুই আর দুই মিলে পাঁচ হবে।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading