‘চালকোলিথিক যুগ’ দ্বারা আপনি কী বোঝেন? চালকোলিথিক যুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান উল্লেখ করুন। What do you understand by Chalcolithic Age? Mention some important sites of Chalcolithic Age

চালকোলিথিক যুগ:

চালকোলিথিক যুগ (Chalcolithic Age), যা “তাম্র-পাথরযুগ” হিসেবে পরিচিত, মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় যা প্যালিওলিথিক (প্রাচীন পাথরযুগ) এবং ব্রোঞ্জ যুগের (তাম্র যুগ) মধ্যবর্তী সময়কাল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যুগের প্রায় সময়কাল ৪,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ধরা হয়। এই সময়কাল মূলত পাথরের সরঞ্জামের পাশাপাশি তাম্রের ব্যবহারের উন্নতির সাথে সম্পর্কিত। চালকোলিথিক যুগের উন্নতির ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।

চালকোলিথিক যুগের বৈশিষ্ট্য:

১. তাম্রের ব্যবহার:

চালকোলিথিক যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাম্রের ব্যবহার। এই সময়ে মানুষ পাথরের সরঞ্জামের সাথে তাম্রের ব্যবহার শুরু করে, যা কৃষি, শিল্প, এবং অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য নতুন সরঞ্জাম তৈরি করতে সহায়ক ছিল। তাম্রের ব্যবহার সরঞ্জামের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সহজ করে দেয়।

২. কৃষি ও বসতি:

চালকোলিথিক যুগে কৃষির উন্নতি ঘটে। মানুষেরা কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং স্থায়ী বসতির দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ে কৃষি প্রযুক্তি উন্নত হয় এবং মানুষ ধান, গম, মশুর, ও অন্যান্য ফসল চাষ করতে শুরু করে।

৩. নগর পরিকল্পনা:

এই সময়কালে কিছু অঞ্চলে নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের উন্নতি ঘটে। এখানে বাসস্থানের উন্নতি, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

৪. বাণিজ্য ও অর্থনীতি:

চালকোলিথিক যুগে বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চল একে অপরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং নতুন ধরনের পণ্য ও প্রযুক্তি একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে।

৫. সামাজিক শ্রেণীবিভাগ:

চালকোলিথিক যুগে সামাজিক শ্রেণীবিভাগের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়, যা প্রাচীন সমাজের জটিলতা এবং কাঠামো প্রদর্শন করে।

চালকোলিথিক যুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান:

১. হাড়াপ্পা (হারাপ্পা) (বর্তমান পাকিস্তান):

চালকোলিথিক যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল হারাপ্পা, যা সিন্ধু সভ্যতার একটি প্রাথমিক নগর। এখানে উন্নত নগর পরিকল্পনা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং কীর্তিত পাথরের সরঞ্জামের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হারাপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে বেশ কয়েকটি তাম্রনির্মিত সরঞ্জাম এবং শিল্পকর্ম উদ্ধার করা হয়েছে।

২. মোহেঞ্জোদাড়ো (বর্তমান পাকিস্তান):

মোহেঞ্জোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই স্থানে চালকোলিথিক যুগের তাম্র সরঞ্জাম, নগর পরিকল্পনা, এবং শিলালিপি পাওয়া গেছে। এখানে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রমাণিত হয়েছে।

৩. চট্টগাঁও (বাংলাদেশ):

চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান যেমন, দাড়িভাণ্ডার, বিষ্ণুপুর, ও কোরাবাড়ি চালকোলিথিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বহন করে। এখানে চালকোলিথিক পিরামিড, মৃৎশিল্প, ও তাম্রের সরঞ্জামের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

৪. কনৌজ (উত্তরপ্রদেশ, ভারত):

কনৌজের আশেপাশের এলাকায় চালকোলিথিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানে তাম্র সরঞ্জাম, মাটির পাত্র, এবং অন্যান্য শিল্পকর্মের প্রমাণ রয়েছে।

৫. আবিদোস (মিসর):

আবিদোস মিসরের প্রাচীনতম স্থানগুলির একটি, যেখানে চালকোলিথিক যুগের তাম্রনির্মিত সরঞ্জাম এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখানে সমাধি, মন্দির, এবং বিভিন্ন ধরণের তাম্র নির্মিত সরঞ্জামের প্রমাণ রয়েছে।

চালকোলিথিক যুগের প্রভাব:

১. প্রযুক্তিগত উন্নতি:

তাম্রের ব্যবহার চালকোলিথিক যুগের প্রযুক্তিগত উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাম্রের ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটায়।

২. সামাজিক পরিবর্তন:

চালকোলিথিক যুগের সময় সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়, যা সমাজের জটিলতা বৃদ্ধি করে।

৩. অর্থনৈতিক উন্নতি:

বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও অর্থনীতির উন্নতি চালকোলিথিক যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন অঞ্চল একে অপরের সাথে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় করে, যা অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন স্তর তৈরি করে।

৪. স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা:

এই যুগে নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যের উন্নতি ঘটে। উন্নত বসতি, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা নগরের উন্নয়নে সহায়ক হয়।

উপসংহার:

চালকোলিথিক যুগ মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যা পাথরযুগ থেকে তাম্রযুগে প্রবেশের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। এই যুগের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি প্রাচীন মানুষের জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি, এবং সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করে। তাম্রের ব্যবহার, কৃষি ও স্থায়ী বসতির উন্নতি, এবং সামাজিক শ্রেণীবিভাগের প্রমাণ এই যুগের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি চিহ্নিত করে।

Share
error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading