গিরিশচন্দ্র ঘোষ শুধু নাট্যকার নয় অভিনেতা ও মঞ্চ প্রযোজক হিসেবেও গিরিশচন্দ্র ঘোষ বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। সাধারণ রঙ্গালয়ের সূচনা হয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে। নাট্যশিল্প শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য নয়, তা সাধারণ মানুষের বিনোদনের সঙ্গী, নাটককে উচ্চবিত্তর অন্দরমহল থেকে সাধারণ মানুষের দরবারে উপস্থিত করার কৃতিত্ব তাঁরই। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে নাট্য সমালোচক অপরেশ মুখোপাধ্যায়-এর কথা-
“গিরিশচন্দ্র এদেশের নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন মানে-তিনি অন্ন দ্বারা ইহার প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন, বারবার স্বাস্থ্যকর আহার দিয়া ইহাকে পরিপুষ্ট করিয়াছিলেন; ইহার মজ্জায় মজ্জায় রসসঞ্চার করিয়া ইহাকে আনন্দপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন; আর এই জন্যই গিরিশচন্দ্র Father of the Native Stage। ইহার খুড়ো জ্যাঠা আর কেহ কোনদিন ছিল না।”
গিরিশচন্দ্র যখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেন তখন বাংলা নাটকের শৈশব দশা। রামঞ্চের প্রয়োজনে যেমন তাঁকে নাটক লিখতে হয়েছে তেমনি মঞ্চের প্রয়োজন মেটাতে উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতেও হয়েছে। সাধারণ রঙ্গালয়কে কেন্দ্র করে তখন বাংলা নাট্যসাহিত্যে জোয়ার এসেছে। নাট্যমোদী দর্শকের পিপাসা মেটাতে গিরিশচন্দ্র ঘোষকে যেন অবিরাম নাটক লিখে যেতে হয়েছে। গিরিশচন্দ্রেব পৌরাণিক নাটকগুলি হল- ‘অভিমন্যু বধ’, ‘রাবণবধ’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘চৈতন্যলীলা’ ও ‘বিশ্বমঙ্গল’। পৌরাণিক নাটকে হিন্দুধর্মের প্রাচীন শাস্ত্র-ন্যায়নীতি, চরিত্র ও কাহিনিকে নানাভাবে রূপদান করেছেন। এ সম্পকে তিনি নিজেই জানিয়েছেন-“হিন্দুস্থানের মর্মে মর্মে ধর্ম। মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিতে হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে। এই মর্মাশ্রিত ধর্ম বিদেশীর ভাষণ তরবারি ধীরে উচ্ছেদ হয় নাই।”
ঊর্বশীর শাপমোচনকে সামনে রেখে লিখেছেন ‘পাণ্ডব গৌরব’ নাটক। কুর, ভীম চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভক্তিমূলক নাটক হিসেবে উনিশ শতকে সমূহ প্রশংসা লাভ করেছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বিশ্বমঙ্গল’ নাটকটি। স্বয়ং বিবেকানন্দ এই নাটকটির প্রশংসা করেছিলেন। বিশ্বমঙ্গলাল, চিন্তামণি, অহল্যা চরিত্রগুলি উনিশ শতকের ধর্মমূলক জাতীয়তাবাদ সঞ্চারে সমূহ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। গিরিশচন্দ্রের সর্বাধিক পরিচিত পৌরাণিক নাটক ‘জনা’। এই নাটকের প্রবীর, জনা, নীলধ্বজ, অর্জুন কেউই বাস্তবের চরিত্র নয়। সবই দেব চরিত্র। পৌরাণিক নাটক যে বাস্তবের উর্ধ্বে কাহিনি বিরাজ করে সেদিক থেকে ‘জনা’ নাটকেও সেই সত্য রক্ষিত হয়েছে। পৌরাণিক নাটকে নিয়তিবাদ-এর বড়ো ভূমিকা থাকে। ‘জনা’ নাটকেও কর্মফলবাদ বা নিয়তিবাদের ভূমিকা দেখা যায়। অশ্বমেধের অশ্ব বন্ধন করলে বিদূষকের সংলাপে অবধারিত পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। ‘জনা’ নাটকে পৌরাণিক চরিত্র এলেও অলৌকিক বিষয় নেই। এমনকি কৃষ্ণ চরিত্রের কোনো অলৌকিকতাই দেখি না। পাণ্ডাবদের বন্ধু হিসেবে সে নাটকে উপস্থিত হয়েছে। এমনকি কথাবার্তায় কোনো উদ্ভট ভাব বা অবাস্তবতা লক্ষিত হয়নি। ভক্তিবাদের প্রসঙ্গ রয়েছে কুরু কর্তৃক বৃষকেতুকে নির্দেশ দানের মধ্যে-
“তোমা সম ভক্ত মম বিরল ভুবনে
ক্ষুদ্ধচিত্ত না হও, ধীমান।
বাড়াতে ভক্তের মান তাপ সহি আমি,
ভক্তের প্রসাদে সেই তাপ যায় দূরে।”
‘জনা’ নাটকটি পৌরাণিক আধারেই রচিত হয়েছে। সংলাপ, পাত্রপাত্রী, বিষয়বস্তু সবই পৌরাণিক অবয়বকে সামনে রেখেই গড়ে উঠেছে। নাটকে প্রবীর মদনমঞ্জুরীর প্রেম বিশেষ প্রাধান্য পায়নি। তার বদলে বড়ো হয়ে উঠেছে ভক্তিবাদ। শ্রীকৃত্ব, অগ্নির নানা উপদেশের মধ্য দিয়ে নাটকে নীতিবাদ নানাভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, যা পৌরাণিক নাটকের বিশেষ লক্ষণ। উনিশ শতকের পৌরাণিক নাটকের ধারায় গিরিশচন্দ্র শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেছিল।