‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি কে বলেছেন এবং কেন বলেছেন ?

‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি কে বলেছেন এবং কেন-

দেকার্ত যখন বলেন, “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি।” তখন সে তার অস্তিত্বকে কোন সহানুমানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে না,, বরং একটা অনিবার্য সত্য হিসেবে প্রত্যক্ষ করে যা তার নিজের আলোকেই উদ্ভাসিত। “আমি অস্তিত্বশীল” চিন্তার এমন একটি সরল প্রক্রিয়া যা সরাসরি স্বজ্ঞার কাছে প্রস্ফুটিত হয়। এখন কথা হলো এই “আমি” টা এত সুনিশ্চিত হয় কীভাবে?

এখানে এসে দেকার্ত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, “আমি” এমন একটি জিনিস যার মূলধর্ম হল চিন্তা করা অর্থাৎ যেটা সংশয় করে, উপলব্ধি করে, কল্পনা করে, ধারণা করে, ইচ্ছা করে। আর যে জিনিস এসব কাজ করতে পারে তা অবশ্যই এমন একটি চিৎ বা আত্মা, এমন একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য যা তার অস্তিত্বের জন্য কোন জড়পদার্থের ওপর নির্ভরশীল নয়, হতে পারে না। এর অর্থ হলো মন বা আত্মা দেহের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণ, দেহনিরপেক্ষ। দেহের অবর্তমানেও আত্মা তার স্বরূপ বজায় রাখতে সক্ষম।

এখানে এসেই দেকার্ত দেহ ও মনকে আলাদা করে দ্বৈততার উদ্ভব ঘটালেন। সেইসাথে একটা গন্ডগোলও লেগে গেছে তিনি বলছেন মন বা আত্মা অর্থাৎ মন এবং আত্মাকে তিনিকে একই জিনিস ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এই আত্মা কী এবং মন কী তিনি এখানে বিস্তারিত বলেননি। বা মনই কীভাবে আত্মা হয়,,,বা আত্মাকে কী আদৌ মন বলা যায়? দেহের অবর্তমানে আত্মা কীভাবে তার স্বরূপ বজায় রাখে?

তাছাড়া দেকার্ত যে চেতনাময় “আমি”(এখানে চেতনাময় বলতে তিনি মনকেই বোঝাচ্ছেন, কেননা তিনি সবকিছুকে সন্দেহকে করে আমি যে চিন্তা করি এই বিষয়টা পেয়েছেন এবং এটাকেই নিজ সত্তা বা সেলফ হিসেবে ধরে নিয়েছেন বলে মনে হয়,,,কিন্তু এটা তিনি কতটুকু ধরেছেন তা নিচে একটু পর আলোচনা করা হবে।) সত্তার কথা বলেন সেটা যে ধারণা, চিন্তা করে এ ব্যাপারগুলো তিনি স্বীকার করেন। কিন্তু চিন্তা তো মনে আসে এবং এরপর সে(মন) তা নিয়ে বিচার চালায়। এ থেকে দেখা যায় যে, মনকেই তিনি তার সেই চেতনাময় সত্তা, আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবে ধরে নিয়েছেন যেটা একটু আগে এ লেখাতে বলা হলো।

এখন তিনি যদি তা ধরে নেন তাহলে মন এর সন্দেহ করার প্রবণতা আছে, আর এই হেতু তিনি মনের অস্তিত্বকে চেতনাময় ” আমি” বলে চালিয়ে দিলেন। কিন্তু ‘মন’ আর ‘চেতনা’ কী এক? তা তিনি স্পষ্ট করেন নি। যদি মন ও চেতনা ভিন্ন হয় তাহলে মনকেও সন্দেহ করা যেতে পারে। কেননা সন্দেহ ধারণাটি মন থেকে আসে। এখন কথা হলো চেতনা কী মন? এবং “আমি” কী আমার মন? এ প্রশ্ন চলে আসে? দেকার্তের মতে, ‘আমি’ যদি সত্য ধারণা হয়ে থাকে তা হতে হবে Absolute। কিন্তু মন কী Absolute?

না, কারণ এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় ও এর মাঝে যে চিন্তা আসে, সন্দেহ আসে তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। তাহলে চিন্তার কর্তা যদি মন হয় (দেকার্ত অনুযায়ী তা চেতনাও বটে) তাহলে একে Absolute বলা যায় না। কারণ এটি আপেক্ষিক। এবং যেহেতু এটা আপেক্ষিক এটা ‘আমি’ হতে পারে না। সেক্ষেত্রে দেকার্তের হয়তো আরও কিছু সন্দেহ করা উচিত ছিল। এবং সেটি হল নিজের মন যাকে তিনি আবার চেতনময়, আধ্যাত্মিক সত্তাও বলছেন। আর এটা করলে তিনি হয়ত আবিষ্কার করতেন যে, তিনি তার মনও নন।

তাহলে তিনি যদি তার মন না হন তাহলে তিনি কী? কীই বা তার অস্তিত্ব? অর্থাৎ এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এই ‘আমি’র স্বরূপ উদঘাটনে আরও অনেক পথ বাকী রয়ে গেছে যা দেকার্তের পরবর্তী দার্শনিকদের মাঝে আমরা দেখি।

হয়তো দেকার্ত এই ‘আমি’ এর গভীর অন্তদর্শন সম্পর্কে অবগত ছিলেন কিন্তু তা সহজে ও প্রান্ঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে আরও জটিল করে ফেলেছেন বা বলা যায় অস্তিত্ব যাত্রার অনেক স্তর তিনি বাদ দিয়ে ফেলেছেন।

তবে যত কিছুই বলা হোক না কেন দেকার্তের এই ‘আমি’ তিনি ব্যক্তিগতভাবে তথা সাবজেক্টিভভাবে তিনি কীভাবে সেটা ধারণা করতেন তা বলা মুশকিল। এছাড়া তার লেখা মেডিটেশন তথা ‘অনুধ্যান’ বই ল্যাটিন থেকে ইংরেজী করতে গিয়ে অনেক কথার জায়গা পরিবর্তন হয়ে গিয়ে থাকতেও পারে। এছাড়া ভাষা বেশ সীমাবদ্ধ একটা বিষয় আমরা যা ভাবি তা আসলে কী এটা লেখার কায়দায় আসতে আসতে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দেকার্ত যেটাকে “আমি” বলেছেন সেটা কোন “আমি” তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়, এটা দেকার্ত কিংবা দেকার্তের চিদগত আত্মা,ফাত্মাই ভালো বলতে পারবে।

Share

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading